সংক্রমণের চতুর্থ স্তরে বাংলাদেশ
দেশে করোনায় আক্রান্ত ২১৮ জন : মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ালো ২০
—————————————————————————–ভি বি রায় চৌধুরী-দেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৮ মার্চ। গতকাল আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
নতুন শনাক্ত হয়েছে ৫৪। এই নিয়ে এক মাসে রোগী শনাক্ত হয়েছেন মোট ২১৮ জন। আর মারা গেছেন ২০ জন। ইতিমধ্যে ১৭টি জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার ৫২টি এলাকা লকডাউন করেছে কর্তৃপক্ষ। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক দূরত্ব কার্যকর করতে চলছে সাধারণ ছুটি। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের সংক্রমণের ধারা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পরবর্তী এক মাসের কিছু আগে-পরে সংক্রমণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন সেই সময়ের মুখোমুখি।
পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট হয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বক্তব্য আসার পর। গত মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী প্রলয় সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, সারা বিশ্বে যেভাবে করোনা রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে, বৃদ্ধি পাওয়ার একটা ট্রেন্ড (প্রবণতা) আছে। তাতে আমাদের সময়টা এসে গেছে, এপ্রিল মাসটা। এই সময়টা আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।
দেশবাসী করোনা পরিস্থিতি জানতে পারছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কাছ থেকে। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা গতকাল দৈনিক জনতাকে বলেন, এখন সংক্রমণ পরিস্থিতির ক্রান্তিকাল। দেশ সংক্রমণের তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরের দিকে যাচ্ছে, এটা বলা যায়। রোগ সংক্রমণের চতুর্থ স্তরে পৌঁছানোর অর্থ, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে বহু মানুষ, বহু মানুষকে হাসপাতালে যেতে হবে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ক্রান্তিকালে করোনা মোকাবিলায়
দেশের প্রস্তুতি কোন পর্যায়ে। সংক্রমণের হার কি প্রস্তুতির তুলনায় বেশি? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, সব দেশের মতো বাংলাদেশও এই ভাইরাসের পেছনে আছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও এর ব্যাপকতার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের দেশগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করেছে। একজনেরও সংক্রমণ শনাক্ত না হওয়া দেশ স্তর-১-এ। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তি শনাক্ত হওয়া ও তাঁদের মাধ্যমে দু-একজনের সংক্রমণ, স্তর-২। নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সংক্রমণ সীমিত থাকলে তা স্তর-৩। আর স্তর-৪ হলো সংক্রমণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া। ৮ মার্চ বাংলাদেশ প্রথম ঘোষণা করে, দেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তি আছে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সংক্রমণ পরিস্থিতির দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছায়। সংক্রমিত ব্যক্তিরা ছিলেন বিদেশফেরত। এটাকে স্থানীয় সংক্রমণ বলা হয়।
এই বিদেশফেরত ব্যক্তিদের মাধ্যমে বেশ কিছু মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে এমন বলতে থাকে আইইডিসিআর। কিন্তু দুই সপ্তাহ আগে রাজধানীর টোলারবাগ এলাকায় একটি সংক্রমণের ইতিহাসে দেখা যায়, সংক্রমিত ব্যক্তির বিদেশ ভ্রমণ বা বিদেশফেরত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার ইতিহাস নেই। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, সংক্রমণ কি তাহলে সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে? এরই মধ্যে ৫ এপ্রিল সংক্রমণের তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ এমন বক্তব্য দেন আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা। তিনি বলেন, রাজধানীর টোলারবাগ ও বাসাবো, নারায়ণগঞ্জ, মাদারীপুর (শিবচর) ও গাইবান্ধা (সাদুল্লাপুর) এই পাঁচটি এলাকায় গুচ্ছ আকারে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে।
এ ছাড়া জামালপুর, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা, কুমিল্লা, কঙ্বাজার, গাজীপুর, মৌলভীবাজার, নরসিংদী, রংপুর, শরীয়তপুর ও সিলেটে সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। এ থেকে অনেকেই মনে করেন, সংক্রমণ এখন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কত মানুষ আক্রান্ত, তার সঠিক হিসাব এখনো জানা যায়নি। কারণ, নমুনা পরীক্ষার পরিধি ও সংখ্যা এখনো খুবই কম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, সংক্রমণের যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে একে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন (ব্যাপক জনগোষ্ঠীতে সংক্রমণ) বলতে বাধা নেই। তবে মীরজাদী সেব্রিনা বলেছেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি চতুর্থ স্তরে কি না, তা কোভিড-১৯ বিষয়ক কারিগরি কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে।
দেশ ভাইরাসের পেছনে এখন প্রশ্ন উঠেছে, ভাইরাসের সংক্রমণের চেয়ে বাংলাদেশ কি পিছিয়ে? এই প্রশ্নের উত্তর একেকজন একেকভাবে দিয়েছেন। প্রত্যেকেই সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা ও পরীক্ষার ফলাফলের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।
দেশে এখনো রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা কম হচ্ছে। প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে এ পর্যন্ত ঢাকা মহানগর এবং ঢাকার বাইরের অংশ চট্টগাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর ও খুলনায় কোভিড-১৯ এর জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতালগুলোতে মোট আইসোলেশন শয্যা রয়েছে সাত হাজার ৬৯৩টি। এরমধ্যে ঢাকা মহানগরীতে এক হাজার ৫৫০টি, ঢাকা শহরের বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে রয়েছে ছয় হাজার ১৪৩টি। এই তথ্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনা।
বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে আরও তিন জন মারা গেছেন। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২০ জনে। এ ছাড়া, নতুন আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২১৮ জন। তবে গতকাল বুধবার নতুন করে কেউ সুস্থ হননি। ঠিক এক মাস আগে দেশে প্রথমবারের মত কারো দেহে সংক্রমণ ধরা পড়ার পর এক দিনে আক্রান্তের এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা।
গতকাল বুধবার দুপুর আড়াইটার দিকে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে অনলাইনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৈনন্দিন স্বাস্থ্য বুলেটিনে এ তথ্য জানিয়েছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তহমিনাও উপস্থিত ছিলেন ব্রিফিংয়ে। আগে এই অনলাইন ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ থাকলেও এখন তা বন্ধ করে দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একে বলছে ‘স্বাস্থ্য বুলেটিন’।
তিনি বলেন, সারা বাংলাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ৯শ’ ৮১টি পরীক্ষা হয়েছে। ৯শ’ ৮১ পরীক্ষার ভিত্তিতে আমরা গত ২৪ ঘণ্টায় যতজনের মধ্যে সংক্রমণ পেয়েছি সেই সংখ্যা হচ্ছে ৫৪ জন। সর্বমোট কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা ২শ’ ১৮। গত ২৪ ঘণ্টায় কোভিড-১৯ সংক্রান্ত সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩ জন। মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২০। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন এরকম কেউ নেই। ফলে মোট সুস্থ হওয়ার সংখ্যা ৩৩ জন।
ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, নতুন আক্রান্ত ৫৪ জনের মধ্যে পুরুষ ৩৩ জন ও নারী ২১ জন। বয়সের হিসাবে ১১-২০ বছর বয়সের পাঁচ জন, ২১-৩০ বছর বয়সের ১৫ জন, ৩১-৪০ বছর বয়সের ১০ জন, ৪১-৫০ বছর বয়সের সাত জন, ৫১-৬০ বছর বয়সের সাত জন এবং ষাটোর্ধ্ব রয়েছেন ১০ জন। এলাকাভিত্তিক বিশ্লেষণে আমরা দেখতে পাই, ৫০ জনের মধ্যে ঢাকা শহরে রয়েছেন ৩৯ জন। ঢাকা শহরে বাইরে ঢাকার অদূরে যেসব উপজেলা রয়েছে সেখানে ১ জন। আর বাকিরা সবাই ঢাকার বাইরে। প্রেস ব্রিফিংটিতে আরও বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় ৭৩৭ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এছাড়া ১৩৯ জনকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে মোট ১০,২৫৭ জন কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় ভাইরাসটির উপস্থিতি না পাওয়ায় ৪২ জনকে কোয়ারেন্টাইন থেকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
বেসরকারি চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সমীর সাহা বলেন, ভাইরাসের সংক্রমণ যে হারে ছড়াচ্ছে, তাতে বলার সুযোগ নেই যে দেশ ভাইরাসের আগে আছে।
পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে এ কথা স্বীকার করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহামারিবিষয়ক প্রস্তুতি কমিটির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মাহদুদুর রহমান। তিনি বলেন, ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ও ভাইরাস সমান্তরাল অবস্থানে আছে। তিনি মনে করেন, সামাজিক দূরত্ব তৈরি করার সরকারি উদ্যোগ সময়োপযোগী। তবে একে জোরদার রাখতে হবে।